Friday, 12 September 2025

পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮ এর প্রস্তাবিত সংশোধনীর বিশ্লেষন

বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটি (বিপিপিএ) সম্প্রতি পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮ সংশোধনের লক্ষ্যে প্রস্তাবিত খসড়া ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে। উক্ত প্রস্তাবিত সংশোধনীসমূহের কিছু গুরুত্বপূর্ন বিষয়ে নিম্নে বিশ্লেষনসহ আলোকপাত করা হলোঃ 

  1.  এখানে এতো বেশি সংশোধন প্রস্তাব করা হয়েছে যে এটা সংশোধন হিসাবে জারী না করে বরং সম্পূর্ণ নতুন বিধিমালা হিসাবে জারী করলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকবে। কাজেই "পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা, ২০০৮" বাতিলপূর্বক "পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা, ২০২৫" জারী করা যেতে পারে।
  2.  বিধি ৪ এ নতুন উপবিধি ১৪ সংযোজন করে কোনো বিশেষ ক্রয়ের জন্য বিপিপিএ কর্তৃক প্রকাশিত আদর্শ দলিল না থাকলে উন্নয়ন সহযোগী বা বিদেশী সংস্থার আদর্শ দলিল ব্যবহারের সুযোগ রাখা হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে  ভালো প্রস্তাব। তবে শুধু আন্তর্জাতিক কেন? দেশীয় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রনীত আদর্শ দলিল কেন ব্যবহারের অনুমতি দেয়া যাবে না? দেশীয়  মানেই খারাপ এই মানসিকতা থেকে আমাদের বের হতে হবে।
  3. বিধি ৫ এর উপ-বিধি ৪ সংশোধন করে ১৮ মাসের বেশী সময়ের চুক্তির ক্ষেত্রে "মূল্য সমন্বয়" (Price Adjustment) এর ব্যবস্থা রাখা বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আগে মূল্য সমন্বয়ের বিষয়টি ঐচ্ছিক ছিল এবং অভ্যন্তরীণ ক্রয়ের ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ নেই বললেই চলে, যদিও আন্তর্জাতিক ক্রয়ে সাধারনতঃ এরুপ শর্ত থাকে। এতে দীর্ঘ মেয়াদী চুক্তির ক্ষেত্রে ঠিকাদারগণের ঝুঁকি বেশ খানিকটা কমবে। এতে ঠিকাদারগণ আরও কম দর প্রস্তাব দেয়ার জন্য উৎসাহিত হবে। 
    প্রস্তাবিত বিধিতে ১৮ মাসের কম সময়ের চুক্তির ক্ষেত্রেও 
    মূল্য সমন্বয়ের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে য আগে ছিল না। এটি ভালো প্রস্তাব। কারন পেট্রোলিয়াম জাতীয় পণ্য, কৃষি পণ্য কিংবা আকরিক ধাতু ক্রয়ের ক্ষেত্রে স্বল্প মেয়াদী চুক্তির ক্ষেত্রেও মূল্য সমন্বয়ের সুযোগ থাকা প্রয়োজন। 
  4. বিধি ৮ এর উপবিধি ২ সংশোধন করে মূল্যায়ন কমিটিতে সরকারি ক্রয় বিষয়ে প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণকে অগ্রাধিকার প্রদানের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পদবীর ভিত্তিতে কমিটির সদস্য অন্তর্ভুক্তি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এতে করে প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিয়োগ সীমিত হয়ে যাবে। কারণ ঐ পদে যিনি থাকবেন তিনি পদাধিকার বলে সদস্য হয়ে যাবেন যায় প্রশিক্ষন নাও থাকতে পারে। নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ থাকা উচিৎ। 
  5. বিধি ৮ এর উপবিধি ১৫ ও ১৬ বিলুপ্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি,  দরপত্র উন্মুক্তকরন কমিটি এবং কারিগরী সাব-কমিটি এর সম্মানী বিলুপ্ত হবে। এটা করা হলে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (PIC) এবং প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটি (PSC) এর সম্মানীও বিলুপ্ত করা উচিৎ। তবে কমিটির বহিঃ সদস্যগণের জন্য সম্মানী বহাল রাখা যেতে পারে।
  6. বিধি ১৫ এ ক্রয় পরিকল্পনার (Procurement Plan) পাশাপাশি ক্রয় কৌশল (Procurement Strategy) অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। 
  7. বিধি ৩৮ এ সাতটি নতুন উপবিধি যোগ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। উল্লেখযোগ্য সংযোজন নিম্নরুপঃ 
    1.  নতুন উপবিধি ১৬ অনুযায়ী সকল ধরনের চুক্তির ক্ষেত্রে "ক্রয়চুক্তি বাস্তবায়ন পরীক্ষন ও গ্রহন কমিটি" গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এটা একটা যুগোপযুগী প্রস্তাব। এতে প্রকল্প বাস্তবায়নের গুনগতমান বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি প্রকল্প পরিচালকের ক্ষমতার স্বেচ্ছাচারী ব্যবহারে লাগাম টানা যাবে। 
    2. নতুন উপবিধি ১৭ অনুযায়ী আয়কর, ভ্যাট ইত্যাদী পরিবর্তন হলে চুক্তি সংশোধন করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে ঠিকাদারগণের ঝুঁকি বেশ খানিকটা কমবে। এতে ঠিকাদারগণ আরও কম দর প্রস্তাব দেয়ার জন্য উৎসাহিত হবে। 
    3. নতুন উপবিধি ২০ অনুযায়ী ক্রয়কারী কার্যালয় প্রধানের উপরের ধাপে চুক্তি অনুমোদিত হলে ক্রয়কারী কার্যালয় প্রধান সিমীত পরিসরে ভেরিয়েশন অর্ডার অনুমোদন করার ক্ষমতা প্রদান করার প্রস্তাব হয়েছে। এটি ভালো সংযোজন। এতে প্রকল্প বাস্তবায়ন তরান্বিত হবে। তবে ক্রয়কারী কার্যালয় প্রধান কিংবা তার নীচের ধাপে যেসব দরপত্র অনুমোদিত হয়, সেগুলোর ক্ষেত্রেও ভেরিয়েশন অর্ডার অনুমোদন আরো সহজতর করা যেতে পারে। এতে এতে প্রকল্প বাস্তবায়ন গতিশীল হবে।
  8. বিধি ৩৯ এর পর তিনটি নতুন বিধি যোগ করা হয়েছেঃ ৩৯ক, ৩৯খ, ৩৯গ। এগুলো ভেরিয়েশন অর্ডার সম্পর্কিত। এই তিনটি নূতন বিধি এমনভাবে লেখা উচিৎ যেন উহা কার্য, পণ্য, সেবা সকল ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয়। যেমনঃ ঠিকাদার শব্দের পরিবর্তে "ইকোনোমিক অপারেটর" ব্যবহার করা উচিৎ।
  9.  বিধি ৪০ এর পর একটি নতুন বিধি ৪০ক যোগ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এই বিধির ১(খ) উপ-বিধি অনুয়ায়ী, পণ্যের অতিরিক্ত সরবরাহ আদেশ জারীর ক্ষেত্রে মূল চুক্তি বহির্ভূত কোনো আইটেম ক্রয় করা যাবে না। এটা খুব বেশি কঠোর হয়ে যাচ্ছে। মূল চুক্তির সর্বোচ্চ ১% পর্যন্ত নতুন আইটেম গ্রহণযোগ্য হতে পারে। 
  10.  বিধি ৪১ এর উপ-বিধি ১ এর পরে নতুন একটি উপ-বিধি (১ক) যোগ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত এই উপ-বিধি অনুযায়ী, পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কর্মী (বিশেষজ্ঞ) পরিবরতনের ক্ষেত্রে সমতুল্য কিংবা অধিকতর যোগ্যতাসম্পন্ন হওয়ার শর্ত আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু এটা সব সময় প্রতিপালন সম্ভব নয়। তাই এতো কঠোর বিধি যুক্তিযুক্ত নয়। যেমনঃ 
    ১) দেশের সবচেয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে যদি বিশেষজ্ঞ হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়, তাঁর প্রতিস্থাপন কিভাবে হবে? 
    ২) প্রকল্পের শেষের দিকে প্রতিস্থাপন প্রয়োজন হলে যোগ্যাতাসম্পন্ন কেউ আসতে চান না, যেহেতু খুব স্বল্প সময়ের চাকরি। তখন জুনয়র কাউকে নেয়া ছাড়া উপায় থাকে না। 
    কাজেই এই বিষয়টি বিধিতে না এনে বরং চুক্তিতে যথাযথভাবে উল্লেখ থাকতে পারে।
  11.  ভৌত সেবা চুক্তি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত একটি নতুন বিধি ৪১ক যোগ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই বিধির উপ-বিধি ৪ অনুযায়ী আনুপাতিক হারে প্রদত্ত অগ্রীম আদায় করার কথা বলা হয়েছে। এভাবে কর্তন করলে শতভাব অগ্রগতি না হওয়া পর্যন্ত প্রদত্ত অগ্রীম সম্পূর্ণ আদায় হবে না। "আনুপাতিক হারে" এর পরিবর্তে "চুক্তির শর্ত অনুযায়ী" অধিকতর যুক্তিযুক্ত হবে। কারণ অগ্রীম সাধারণত বেশি হারে কাটা হয় যেন ৭০%-৯০% অগ্রগতি হলেই পুরো অগ্রীম আদায় হয়ে যায়।
  12. সরাসরি ক্রয়ের জন্য বিধি ৭৬ এর উপ-বিধি ১ এর দফা (ট) সংশোধন করে শুধু ক্রয়কারীর কার্য এলাকা হতে ভৌত সেবা ক্রয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বরং জটিলতা বাড়বে। 
    "ক্রয়কারীর কার্য এলাকায়" এরূপ শর্ত দেয়া হলে, উপজেলার একজন ক্রয়কারী পাশের উপজেলা থেকে ভৌত সেবা নিতে পারবেন না। কিন্তু ঐ সেবাটি হয়তো পাশের উপজেলায় থাকলেও নিজের উপজেলায় নাও থাকতে পারে। 
    আবার ইউনিয়ন পর্যায়ের একজন ক্রয়কারীর কার্য এলাকা তার নিজের ইউনিয়ন ধরা হলে তিনি এই বিধির তেমন কোনো ব্যবহার হয়তো তিনি করতে পারবেন না। 
    "কার্য এলাকা" নির্ধারণে জটিলতা তৈরি হবে।

  এবারের সংশোধনী প্রস্তাবসমূহ বাস্তবায়ন করা হলে বাংলাদেশের সরকারি ক্রয়ের পরিবেশে অনেক পরিবর্তন আসবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেক জটিলতার অবসান হবে বলে আশা করা যায়। তাছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নে জবাবদিহিতা আরও বৃদ্ধি পাবে। তাই যত দ্রুত সম্ভব পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮ সংশোধন করা উচিৎ। 

 

পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮ এর প্রস্তাবিত সংশোধনীর বিশ্লেষন

বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটি (বিপিপিএ) সম্প্রতি পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮ সংশোধনের লক্ষ্যে প্রস্তাবিত খসড়া ওয়েবসাইটে প্রকাশ ক...

See the most popular posts on public procurement of Bangladesh: